বুধবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

ডিম খাবেন নাকি খাবেন না??


ডিম খাবেন নাকি খাবেন না?? 

ডিম সম্পর্কে ভুল ধারণা : প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় বিশেষ করে নাস্তার সময় সবাই ডিম খেতে পছন্দ করেন। সময় স্বল্পতার জন্য ভাতের সঙ্গে তরকারির বিকল্প হিসেবে ডিম ভাজি বা ভর্তা করেও অনেককে খেতে হয়। তবে অনেকের মাঝেই ডিম নিয়ে এক ধরনের ভুল ধারণা আছে, তা হলো, সব বয়সে ডিম খাওয়া যায় না, অথবা দিনে একটার বেশি ডিম খাওয়া যায় না। আবার কেউ মনে করেন, ডিমের কুসুম খাওয়া যায় না। আসল সত্য হলো, আন্তর্জাতিক পুষ্টি বিজ্ঞানী এবং ডাক্তারদের মতে, যে কোনো বয়সেই ডিম খাওয়া যায়, এমনকি দিনে কয়েকটি ডিম খেতেও কোনো বাধা নেই। সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থ জাতি গঠনে প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য ডিম হতে পারে খাদ্যের অন্যতম উৎস। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিন অন্তত একটি করে ডিম খাওয়া উচিত। প্রশ্নটা হলো প্রতিদিন বা নিয়মিত ডিম খাওয়া যাবে কি যাবে না। এ নিয়ে ডাক্তার, রোগী এমনকি সুস্থ মানুষের মাঝেও বিভ্রান্তি বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল এবং এখনো আছে। বিশেষ করে যাদের বয়স একটু বেশি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগী অথবা যাদের রক্তে কোলেস্টেরল বা অন্যান্য চর্বির পরিমাণ বেশি, তাদের ডিম খেতে নিষেধ বা সম্পূর্ণ বর্জন করতে বলা হয়। অনেকেই এমনকি কিছু কিছু চিকিৎসক আবার ডিমের কুসুম বাদ দিয়ে শুধু সাদা অংশটুকুই খেতে বলেন। এর কারণ তাদের ধারণা একটাই, তা হলো ডিম খেলে রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ে, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। আসলে এত দিনের এই ধারণাটা মোটেই সত্য নয়। ডিম খেলে রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা ততটা বৃদ্ধি পায় না। একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষ দৈনিক গড়ে ৩০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত কোলেস্টেরল গ্রহণ করতে পারেন। আর একটি ডিমে রয়েছে মাত্র ২০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল। তাই বিশেষজ্ঞরা এমনকি আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এখন আর তাদের খাদ্যের গাইডলাইনে ডিম খাওয়াকে নিরুৎসাহিত করছেন না। যে কোনো ব্যক্তি ডিমের সাদা অংশ খেলে কোনো সমস্যা তো হবেই না, এমনকি কুসুমসহ সম্পূর্ণ ডিম খেলেও উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও হৃদরোগের ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আরেকটি বড় গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, প্রতি সপ্তাহে ৫-৬টি ডিম খেলে হৃদরোগ, স্ট্রোক বা অন্যান্য ধরনের হৃদরোগের কোনো ঝুঁকিই নেই। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে বলা হয়, দিনে ১টি ডিম হার্টের জন্য ক্ষতিকর নয়। সকালের নাস্তায় একটি ডিম কোলেস্টেরল প্রোফাইলের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না, যতটা প্রভাব ফেলে আপনার সকালের নাস্তায় মিষ্টি বা চর্বি জাতীয় খাবার খেলে।

ডিমের পুষ্টিগুণ : ডিমের মধ্যে আছে পানি, প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন এ, ই, বি৬, বি১২, ফলেট, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, আয়রন, খনিজ পদার্থ যেমন জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম ইত্যাদি। বলতে গেলে ডিমে সব ভিটামিনই কমবেশি থাকে, তবে ভিটামিন সি কিন্তু নেই। শরীরের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কোলিন, যা কেবল ডিমেই বেশি পাওয়া যায়, অন্যান্য সহজলভ্য খাদ্যে ততটা পাওয়া যায় না। খাদ্যের এই উপাদানগুলো ডিম খেলে সহজেই পাওয়া যায় এবং দামেও সাশ্রয়ী। ডিমের মধ্যে যে প্রোটিন, ভিটামিন বি ১২, রাইবোফ্ল্যাভিন, ফলেট ও ভিটামিন ডি রয়েছে, তা কোলেস্টেরল বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দেয়। এমনকি অনেক দিন সংরক্ষিত বা প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়ার চেয়ে ডিম ভালো বিকল্প খাদ্য হতে পারে।
হাঁস না মুরগি, লালচে না সাদা : অনেকে হাঁস বা মুরগির ডিম এমনকি সাদা বা লালচে ডিম খাওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেন, আসলে সব ধরনের ডিমের পুষ্টিগুণ একই রকম। তবে হাঁসের ডিমে প্রোটিন এবং চর্বির মাত্রা সামান্য বেশি, খেতে কোনো মানা নেই। কেউ কেউ আবার কাঁচা ডিম খেতে পছন্দ করেন, এমনকি কাঁচা ডিমের পুষ্টিগুণ বেশি বলে মনে করেন, এ ধারণাটাও সত্যি নয়। বরং কাঁচা ডিম খেলে সালমোনেলা জাতীয় ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে। আবার কোয়েলের ডিম নিয়েও কেউ কেউ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেন, যা আকারে ছোট। ৫টি কোয়েলের ডিম একটি মুরগির ডিমের সমান। পুষ্টিগুণ কিন্তু একই রকম। আবার এ কথাও সত্য, ডিম যেভাবেই রান্না হোক না কেন, এর পুষ্টিগুণ প্রায় অবিকৃত থাকে, এমনকি পেটে সহজেই হজম ও সম্পূর্ণ শোষিত হয়।
দিনে কয়টি ডিম খাওয়া যাবে : তরুণরা এবং যারা বেশি কায়িক পরিশ্রম করেন, তারা নিয়মিত ডিম খেতে পারেন, এমনকি দিনে ৩টি ডিম খাওয়াও সম্পূর্ণ নিরাপদ। বয়স্করাও সপ্তাহে কয়েকটি ডিম খেতে পারবেন। আর যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছেন, তাদের সুস্বাস্থ্যের জন্যও নিয়মিত ডিম খাওয়া উচিত। তবে কিডনি অকেজো বা রেনাল ফেইলুরের রোগী ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডিম খাবেন, কারণ কিডনি ফেইলুরে প্রোটিন কম খাওয়া উচিত। কারও কারও বেলায় ডিম খেলে অ্যালার্জি জাতীয় সমস্যা হতে পারে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডিম নিয়ে কিছু টিপস :
১। ডিম অবশ্যই একটি প্রাকৃতিক পুষ্টিকর খাদ্য, যার মধ্যে খাদ্যের সব উপাদানই বিদ্যমান। সব বয়সের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ডিম অত্যন্ত কার্যকর। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি, হাড় গড়নে ও মেধার বিকাশে ডিম খুবই কার্যকর।
২। মহিলাদের শারীরিক চাহিদা পূরণে এবং স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে ডিম অত্যন্ত জরুরি।
৩। ডিমে কোলেস্টেরল আছে বটে, কিন্তু তা রক্তের কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে না। বরং রক্তের ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বৃদ্ধি করে। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাইগ্লিসারাইডও কমায়।
৪। ডিমে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যথেষ্ট পরিমাণে থাকে, যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতায় সহায়ক।
৫। ডিমে আছে ভিটামিন ‘এ’। যা দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে, অন্ধত্ব দূরীকরণেও সহায়ক। ডিমের কেরোটিনয়েড, ল্যুটেন, জিয়াজেনথিন বয়সকালে চোখের ম্যাকুলার ডিজেনারেশন হওয়ার আশঙ্কা কমিয়ে দেয়। এটি চোখের ছানি কমাতেও সহায়তা করে।
৬। ডিমের কুসুমে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘কে’ আছে। এটি রক্তের বিভিন্ন কাজে সহায়ক, হাড় শক্ত ও মজবুত করে এবং প্রজনন অক্ষমতা দূর করতে সহায়তা করে।
৭। নিয়মিত ডিম খেলে হৃদরোগ বৃদ্ধি পায় না, বরং ব্রেনের স্ট্রোক কমাতে সহায়তা করে।
৮। টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ডিম কিছুটা হলেও কার্যকর।
উপসংহারে বলা যায়, ডিম নিয়ে রসালো কথার শেষ নেই, পরীক্ষায় খারাপ হলেই বলে “ডিম পাবে”, নেতিবাচক কোনো কথা হলেই বলা হয় “ঘোড়ার ডিম”, রাস্তায়, নাটকে বা অনুষ্ঠানে ক্ষুব্ধ হলেই জনতা ছুড়ে মারে “পচা ডিম”। তবুও সুস্বাস্থ্য এবং খাদ্যের জরুরি উপাদান এবং প্রোটিন গ্রহণের জন্য নিয়মিত ডিম খাওয়া নিয়ে কোনো বিতর্ক বা বিভ্রান্তির অবকাশ  নেই। প্রতিদিন ডিম খাবেন, যদি সুস্থ থাকতে চান।
লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Popular Posts